ভূমিকা: জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর আন্দোলনের পদ্ধতি ও লক্ষ্য সম্বন্ধে ক্রমেই কংগ্রেস দলের একাংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা কংগ্রেসের নিয়মতান্ত্রিক আবেদন নিবেদন ভিত্তিক আন্দোলনকে 'রাজনৈতিক ভিক্ষাবৃত্তি বলে মনে করে। তারা 'সরাজ লাভকে আদর্শ বলে গ্রহন করে। ফলে কংগ্রেস দল নরমপন্থী’ ও ‘চরমপন্থী’ দুই গােষ্ঠিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধােত্তর পৃথিবীতে যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনি গান্ধিজি ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভূত হলে,কংগ্রেসে গােষ্ঠিদ্বন্দ্ব দূর হয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় সংগ্রাম শুরু হয়।
প্রথম জীবন: গুজরাটের পাের বন্দরে মােহন দাস করম চাদ গান্ধি (১৮৬৯ খ্রিঃ ২রা অক্টোবর) জন্ম গ্রহন করেন। বাল্য শিক্ষা শেষ করে তিনি ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড যান এবং পড়াশুনা শেষ করে ভারতে ফিরে আসেন (১৮৯১ খ্রিঃ) ভারতে আইন ব্যবসায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত না হতে পেরে তিনি দক্ষিন আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয় সংস্থা 'দাদা আবদুল্লা এণ্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সেখানে যান। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিন আফ্রিকার তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন।
দক্ষিন আফ্রিকার ভারতীয়দের অবস্থা:
শ্রমিকের কাজ, ব্যবসা, চাকুরি, প্রভৃতি পেশায় দক্ষিন আফ্রিকায় বহু ভারতীয় নিযুক্ত ছিল। এই প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান পা্সী, খ্রিস্টার্ন ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন ধরনের মানুষ ছিল। এই সময় দক্ষিন আফ্রিকা সরকার 1. ভারতীয়দের নাম নথিভুক্ত করার জন্য বাধ্যতামূলক নিবন্ধীকরন ব্যবস্থা চালু করে। এজন্য সারা রাত্রি জেগে ভারতীয়দের অপেক্ষা করতে হতাে। এছাড়া অভিবাসন, ভারতীয় বিবাহ পদ্ধতিকে স্বীকৃতি না দেওয়া, কার্যকাল শেষ হলেও অনেক শ্রমিক আইনের প্রতিবন্ধকতায় সেখানে থাকতে বাধ্য হতাে। এজন্য তাদের তিন পাউন্ড কর দিতে হতাে। দক্ষিন আফ্রিকায় বর্নবৈযম্যও প্রবল ছিল। কয়েকটি নির্দিষ্ট রাজপথে ভারতীয়দের চলার অধিকার ছিল না।
সত্যাগ্রহ আন্দোলন:
এ সময়েই গান্ধিজি বুশ সাহিত্যিক টলস্টয়ের ঈশ্বরের রাজ্য' (Kingdon of God Within You) ইংরেজ সাহিত্যিক রাসকিনের শেষ পর্যন্ত (Unto he uast) এবং আমেরিকান সাহিত্যিক থরাের আইন অমান্য' (Civil Disobidience) পড়ে প্রতিবাদের নতুন পথের সন্ধান পান। এই নতুন পথ, আদর্শ, অনুসরন করে গান্ধিজি সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে তােলেন। সত্যাগ্রহ ও অহিংস আন্দোলন বলতে বােঝায় - যা সত্য' ন্যায় সঙ্গত এবং যথার্থ দাবি, তার জন্য শান্ত, নিরস্ত্রভাবে অন্যায়ের বিবুধে প্রতিবাদ, সংযম ও অহিংসার সাথে প্রতিপক্ষের হৃদয় জয় করাই হলাে সত্যাগ্রহ।
গান্ধিজি প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তাদের সমস্যাগুলি উপলদ্ধি করে সমাধানের জন্য নিউক্যাসেল খনি শ্রমিকদের সহযােগিতায় নাটাল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। জনসভা, আবেদন, ধরনা, পদযাত্রা, গন কারাবরন, ধর্মঘটের মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন (১৯১৩ খ্রিঃ) সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে প্রায় নয় মাস কারারুদ্ধ রাখলেও আন্দোলন চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দক্ষিন আফ্রিকা সরকার ভারতীয় ত্রান আইন (Indian Relief Act) পাশ করেও তিন পাউন্ড কর প্রত্যাহার করে ভারতীয় বিবাহ পতিকে স্বীকৃতি দেয় (১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ)। গান্ধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য টলস্টয় খামার, ফিনিক্স আবাসনে কর্মীদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তারপর তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ পদ্ধতি প্রয়ােগ করেন। ধর্মীয় বিভেদ থাকলে প্রবাসী ভারতীয়দের তিনি ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। যা পরে ভারতে তাঁকে জাতীয় আন্দোলনে নেতৃত্বের উপযুক্ত করেছিল। এজন্য বলা হয় “দক্ষিন আফ্রিকায় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ উপহার ছিলেন তিনি নিজেই" ( The greatest gift of the Indian struggle in South Africa to the Indian National Movement was Gandhi himself. S.R, Mehrotra-Towards Indian Freedom and Partition) a, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের বেশীর ভাগ ছিলেন মুসলমান ব্যবসায়ী। তাদের ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের শ্রদ্ধা ও সমর্থন গান্ধিজিকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, অবিসংবাদি নেতায় পরিনত করে ছিল।
জাতীয়তাবাদের রূপান্তরঃ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি ভারতে ফিরে আসেন। গােপাল কৃষ্ণ গােখেলের পরামর্শে ভারতীয় জনজীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তিনি ভ্রমন শুরু করেন। আমেদাবাদ সবরমতি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন (১৯১৬ খ্রিঃ)। অহিংসা, সত্যাগ্রহ, গ্রাম ভারতের উন্নয়নের জন্য শিষ্যদের স্গে আলােচনা করেন। এছাড়া ও কয়েকটি কারনে জাতীয়তাবাদের রূপান্তর ঘটে।
প্রথমত, দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা অন্যান্য নেতাদের তুলনায় গান্ধিজিকে সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্বে পরিনত করে (আধুনিক ভারত সুমিত সরকার)। কারন অন্যান্য রাজনীতিকরা ছিলেন মূলতঃ আঞ্চলিক এবং তাদের পিছনে মুসলমান বা অন্য সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন ছিল না।
দ্বিতীয়তঃ হােমবুল আন্দোলন জনজাগরন সৃষ্টি করলেও কংগ্রেসে ও লীগ’এর মধ্যে লক্ষৌ চুক্তি সম্পাদিত হলেও এই আন্দোলন ছিল দক্ষিন ও পশ্চিম ভারতে সীমাব্ধ। জনসংযােগ ছাড়া বক্তৃতা বা প্রস্তাব সর্বস্ব রাজনীতি দিয়ে জনসমাজে প্রভাব বিস্তার করা যায় না, প্রমানিত হয়েছিল।
তৃতীয়ত: সুরাট অধিবেশনে (১৯০৭ খ্রিঃ) বিভাজনের ফলে কংগ্রেস দুর্বল হয়ে পড়ে। চরমপন্থীরা সর্বভারতীয় জাতীয় নেতায় পরিনত হতে পারেনি। তাদের প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি অতি আগ্রহ ও অনুসরন এবং মাতৃ মতবাদ, কৃষ্ণ মতবাদ প্রচার অহিন্দু সম্প্রদায় গুলিকে কংগ্রেস থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।
শেষে বলা যায়, যুদ্ধকালীন সংকট ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সমাজের পরস্পর বিরােধী স্বার্থগুলিকে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলনে পরিনত করেন গান্ধিজি। তার সাধুসুলভ আচরণ, অহিংসা, বেশভূষা, গ্রাম্য সরল হিন্দিতে কথাবার্তা, অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি, হরিজন প্রীতি, স্বদেশী আদর্শ তাকে জনগনের কাছের মানুষে পরিনত করেছিল।
এর ফলে ভারত নাজনীতিতে শুরু হয় এক নতুন যুগ যা গান্ধিযুগ নামে পরিচিত।

0 Comments